ঢাকা, শুক্রবার, ৩ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১, ১৭ মে ২০২৪, ০৮ জিলকদ ১৪৪৫

জাতীয়

জাহাজ নির্মাণ শিল্পে এগিয়ে চলেছে

চট্টগ্রামের এফএমসি ডকইয়ার্ড

স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট ও ব্যুরো এডিটর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২১০৬ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১০, ২০১৩
চট্টগ্রামের এফএমসি ডকইয়ার্ড

চট্টগ্রাম: জাহাজ নির্মাণ শিল্পে এগিয়ে চলেছে চট্টগ্রামের এফএমসি ডকইয়ার্ড লিমিটেড। নবীন হলেও প্রতিষ্ঠানটি বিশাল বিনিয়োগ এবং কর্মদক্ষতা ও আধুনিক প্রযুক্তির সমন্বয় ঘটিয়ে এরই মধ্যে ব্যাপক কর্মযজ্ঞ শুরু করেছে।

অভ্যন্তরীণ চাহিদাপূরণের পাশাপাশি বিদেশে রফতানির জন্য নানা প্যাটার্ন ও ডিজাইনের জাহাজ নির্মাণ করে চলেছে এফএমসি। প্রতিষ্ঠানটি ইতিমধ্যে কন্টেইনার জাহাজ, ট্যাংকার, ফিশিং ট্রলার, ক্রুজ ভ্যাসেল, ড্রেজার, টাগ বোট, পন্টুন নির্মাণে এফএমসি সফলতা দেখাতে সক্ষম হয়েছে।  

সম্প্রতি ইউরোপিয় ইউনিয়নের (ইইউ) রাষ্ট্রদূত উইলিয়াম হান্নাও এফএমসি ডকইয়ার্ড পরিদর্শন করে সন্তোষ প্রকাশ প্রকাশ করেছেন। তিনি পরিদর্শন শেষে মিট দ্য প্রেস অনুষ্ঠানে এফএমসির উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেন।

তিনি বলেন, গার্মেন্ট শিল্পের পর বাংলাদেশের সম্ভাবনাময় অথনৈতিক খাত হচ্ছে জাহাজ নির্মাণ শিল্প। এফএমসি হচ্ছে এই সেক্টরের উজ্জ্বল প্রতিষ্ঠান।

জানা গেছে, চট্টগ্রামের কর্ণফুলী লাগোয়া পশ্চিম গোমদন্ডীতে ৮০ বিঘা জমির উপর এফএমসি ডকইয়ার্ড লিমিটেডের বিশাল অবস্থান। ১৮০ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত এ ডকইয়ার্ডের প্রাথমিক নির্মাণ কাজ শেষ হয় ২০১০ সালে। ইয়ার্ডের অবকাঠামো তৈরি থেকে শুরু করে নিজস্ব ব্যবহারের জন্য বার্জ, ওয়ার্ক বোট, যাত্রীবাহী জাহাজ নির্মাণ করে এফএমসির নেভাল আর্কিট্যাক্ট ও ইঞ্জিনিয়ারদের তত্ত্বাবধানে প্রশিক্ষিত নিজস্ব কর্মী বাহিনী।

২০১১ সালের জানুয়ারিতে আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু করা এফএমসি প্রথমে সফলভাবে নির্মাণ করে অত্যাধুনিক পর্যটন জাহাজ এমভি মাহিরাহ্। জাহাজটির মাধ্যমে সুন্দরবনে পর্যটকদের পরিবহন করছে বেসরকারী পর্যটন প্রতিষ্ঠান গ্রিন চ্যানেল। এ জাহাজ ২২০ জন সাধারণ যাত্রীর ধারণ মতাসম্পন্ন হলেও কেবিন ও অত্যাধুনিক সুযোগ সুবিধার সংযোজন ঘটিয়ে এতে ৪০ জন যাত্রী পরিবহন উপযোগী করা হয়েছে। ৪০ জনের জন্য ২০ টি কেবিন ছাড়াও রয়েছে সুইমিং পুলসহ যাবতীয় ব্যবস্থা। জাহাজটি মূলত ব্যবহার করেন বিদেশি পর্যটকরা।

সেন্টমার্টিনে যাত্রী পরিবহনের জন্য ৩২০ জনের ধারণ ক্ষমতা সম্পন্ন আরেকটি পর্যটক জাহাজ নির্মাণ করছে প্রতিষ্ঠানটি। আগামী কয়েকমাসের মধ্যে সুবিধাজনক সময়ে এ জাহাজের অপারেশনাল কার্যক্রম শুরু হবে। জাহাজটি নির্মাণ আদেশ দিয়েছে ইস্টউড লিমিটেড।

মাত্র ১৫ কোটি টাকায় এফএমসি ডকইয়ার্ড ইতিমধ্যে নির্মাণ করেছে একটি অত্যাধুনিক ১৮ ইঞ্চি কাটার সাকশান ড্রেজার। ড্রেজার এফএমসি মাতৃকা এখন বিআইডবিউটিএ’র বরিশাল প্রকল্পে চ্যানেল ড্রেজিং কাজে ব্যবহৃত হচ্ছে।

আগামী তিনমাসের মধ্যে ডেলিভারি দেয়া হবে আরেকটি অত্যাধুনিক রিসার্চ ভ্যাসেল। ১০ কোটি টাকা ব্যয় সাপেক্ষে এই গবেষণা জাহাজটির কার্যাদেশ দিয়েছে কসমস নামের অস্ট্রেলিয়ান একটি প্রতিষ্ঠান। জাহাজটি ব্যবহৃত হবে বঙ্গোপসাগরের বালি গবেষণা কাজে। এ সময়ের মধ্যে ডেলিভারি দেওয়া হবে আরও পাঁচটি অত্যাধুনিক প্রযুক্তির ফিশিং ট্রলার।

দেশে ফিশিং ট্রলার তৈরির মাধ্যমে এফএমসি প্রতি ট্রলারে প্রায় ৪ কোটি টাকা বৈদেশিক মুদ্রার সাশ্রয় করছে।
তাছাড়া ১৫০ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত ১২ টি অয়েল ট্যাংকারের কাজও দ্রত এগিয়ে চলছে। এসব ট্যাংকারের  ডেলিভারি শুরু হবে ফেব্র“য়ারিতে।

এফএমসি কর্তৃপ জানায়, বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের (বিপিসি) তত্ত্বাবধানে দেশের বিভিন্ন জ্বালানি তেল ডিপোতে তেল সরবরাহ এবং বহির্নোঙরে অবস্থানরত মাদার ভ্যাসেল থেকে অশোধিত জ্বালানি খালাসের কাজে এসব ট্যাংকার ব্যবহার করা হবে। এফএমসিকে এসব জাহাজ নির্মাণের কার্যাদেশ দিয়েছে দেশের কয়েকটি প্রতিষ্ঠিত জাহাজ মালিক প্রতিষ্ঠান। নির্মানাধীন প্রতিটি ট্যাংকার নির্মাণে ব্যয় হচ্ছে ১৩ কোটি টাকা। ৭৪ মিটার দীর্ঘ প্রতিটি ট্যাংকারের ধারণ মতা ১৬০০ মেট্রিক টন।

ইতিপূর্বে দেশের কোনো জাহাজ নির্মাতা প্রতিষ্ঠান নিকট সময়ের মধ্যে একযোগে ১২ টি ট্যাংকার নির্মাণ করেনি। এটি এদেশের জাহাজ নির্মাণ শিল্পে নতুন চমক।
এফএমসি ইতিমধ্যে দেশের অভ্যন্তরে চট্টগ্রাম-পানগাঁও নৌ-পথে কন্টেইনার পরিবহনের জন্য ২ টি অত্যাধুনিক কন্টেইনার জাহাজ নির্মাণ কাজ শুরু করেছে। গত ১ অক্টোবর থেকে এসব কন্টেইনার জাহাজের নির্মাণ কাজ শুরু হয়।

জাহাজগুলোর প্রতিটি ১৪৪ টিইইউ’এস(টুয়েন্টি ফিট ইক্যুয়েল ইউনিট) ধারণ ক্ষমতা সম্পন্ন এবং ৭৯.৫০ মিটার দীর্ঘ। এ রুটে চলাচলের জন্য নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয়ের ইস্যু করা লাইসেন্সে ৩২ টি কন্টেইনার জাহাজের মধ্যে প্রথম দফায় দু`টি নির্মাণের কার্যাদেশ পেয়েছে এ প্রতিষ্ঠান। এটিও দেশের জাহাজ নির্মাণ শিল্পের জন্য নতুন অধ্যায়।  

এছাড়া নির্মাণ চলছে দুইটি ১৮ ও ২০ ইঞ্চির কাটার সাকশান ড্রেজারের। ১২০০ অশ্বশক্তি সম্পন্ন তিনটি টাগ বোট নির্মাণের কাজও দ্রুত এগিয়ে চলছে।
এফএমসি ডকইয়ার্ডে নির্মিত জাহাজ সার্ভে কাজে নিয়োজিত রয়েছে আন্তর্জাতিক সার্ভেয়ার সংস্থা রিনা।
ভবিষ্যতে এফএমসি জাহাজ নির্মাণ শিল্পে অধিকতর বিনিয়োগ ঘটিয়ে আরও বৃহদায়তনের সমুদ্রগামী জাহাজ নির্মাণ এমনকি মাদার ভ্যাসেল নির্মাণের পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে। এফএমসির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. ইয়াছিন চৌধুরী জানান, প্রস্তুতিস্বরূপ আনোয়ারার গহিরা উপকূলে এফএমসি ডকইয়ার্ড-২ নামে বৃহত্তর পরিসরের পরিবেশ বান্ধব অত্যাধুনিক ডকইয়ার্ড নির্মাণ প্রক্রিয়া শুরু প্রক্রিয়া শুরু করা হয়েছে। সেখানে জাহাজ নির্মাণের পাশাপাশি কাটার জন্য আনা জাহাজের গ্রিন ডকিং সম্পন্ন করা হবে।  

এফএমসি ডক ইয়ার্ড লিমিটেড শুধুমাত্র জাহাজ নির্মাণ করেই আত্মতৃপ্তিতে ভূগছে না। বরং সামাজিক দায়বদ্ধতার অংশ হিসেবে এ প্রতিষ্ঠান ক্রিকেট ও ফুটবলসহ অন্যান্য খেলাধূলার প্রসার ও অন্যান্য সামাজিক কর্মকাণ্ডে সক্রিয় ভূমিকা পালন করে চলেছে।

এফএমসির কর্ণধার ইয়াছিন চৌধুরী জানান, দেশ ও জাতি গর্ব করতে পারে-এমন নির্মাণ শিল্পের মধ্যে জাহাজ নির্মাণ শিল্প অন্যতম। এক সময় বাংলাদেশ সমুদ্রগামী জাহাজ, টাগ বোট, ড্রেজার, ট্যাংকার এমনকি ফিশিং ট্রলার পর্যন্ত বিদেশ থেকে আমদানির উপর নির্ভরশীল ছিল।

সেই  বাংলাদেশ এখন দক্ষ মানবসম্পদ ও অত্যাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে সবধরণের জাহাজ নির্মাণ করছে এবং ইউরোপসহ বিভিন্ন দেশে নতুন নতুন জাহাজ রফতানি করছে। এতে করে প্রতিবছর বিপুল বৈদেশিক মুদ্রা আয় ও ব্যাপক কর্মসংস্থানের মাধ্যমে দেশের অর্থনীতিতে জাহাজ নির্মাণ শিল্প উলেখযোগ্য গতিসঞ্চার করতে সম হয়েছে। বাংলাদেশে নির্মিত সমুদ্রগামী জাহাজ বিদেশে ব্যাপক প্রশংসা কুড়িয়েছে। এতে করে বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল থেকে উজ্জ্বলতর হচ্ছে।

ইয়াছিন চৌধুরী বলেন, অর্থনীতির ক্ষেত্রে জাহাজ নির্মাণ শিল্পের বিপুল সম্ভাবনার আলোকে সরকার এ শিল্পের প্রসারে গভীর আগ্রহী ও মনোযোগী হয়েছে। অচিরেই জাহাজ নির্মাণ শিল্প দেশের অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি হয়ে উঠবে।  

বাংলাদেশ সময়: ১৬ ২৩ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১০,২০১৩

টিসি

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।